### বয়স কমে যায় মুহূর্তে: চিরসবুজ অভিনেত্রী ববিতা
ছবিঃ সংগৃহীত |
**ফরিদা আক্তার পপি**, চলচ্চিত্র জগতে ববিতা নামেই অধিক পরিচিত, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এক অবিস্মরণীয় নাম। আজ এই গুণী অভিনেত্রীর ৭১তম জন্মদিন। বাংলাদেশের সিনেমা জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে তিনি চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন। সত্তরের দশকের অন্যতম জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী আজও সিনেমাপ্রেমীদের হৃদয়ে সমান ভাবে রয়েছেন।
#### **শুরুর দিনগুলি**
ববিতা ১৯৫৩ সালের ৩০ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। সিনেমা জগতে তার প্রবেশ ছিল শিশু শিল্পী হিসেবে, চলচ্চিত্র **‘সংসার’** দিয়ে। যদিও এই ছবি তার অভিনয় জীবনের সূচনা হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু তিনি মূলত চলচ্চিত্রে নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন **জহির রায়হানের** ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে। তখন থেকেই তার উত্থান শুরু, আর ফিরে তাকাতে হয়নি। সেই থেকে তার পথচলা এবং তারকা হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু।
#### **মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ববিতা**
স্বাধীনতার পরের সময়টা ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য একটি নতুন অধ্যায়। ববিতার মতো শিল্পীদের অভিনয় দক্ষতা এবং সিনেমায় তাদের অবদান এই নতুন সময়কে আরও রঙিন করে তুলেছিল। **‘ওরা ১১ জন’**, **‘সংগ্রাম’**, **‘আলোর মিছিল’**, **‘আবার তোরা মানুষ হ’**, **‘নয়নমণি’** প্রভৃতি ছবিতে তার অনবদ্য অভিনয় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে সহায়ক হয়েছিল।
#### **ববিতার সাফল্যের বছরগুলো**
১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় আমজাদ হোসেনের **‘গোলাপী এখন ট্রেনে’**। এই ছবিতে প্রধান চরিত্রে ছিলেন ববিতা এবং ফারুক। এটি ছিল একটি রঙিন ছবি, যা সেই সময়ে কমই দেখা যেত। ছবিতে তার অভিনয় মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের, বিশেষ করে প্রথম দৃশ্যের পর থেকেই। যেখানে রওশন জামিল, আনোয়ারা, এবং ববিতা ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরায় ঢুকে যান। এই ছবিতে ববিতা শ্রেণিহীন সমাজের বার্তাকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
এছাড়া **‘সারেং বৌ’** ছবির **‘ওরে নীল দরিয়া’** গানে তার পারফরম্যান্স ছিল অনবদ্য। এই ছবির মাধ্যমে তিনি শহুরে এবং গ্রামীণ উভয় চরিত্রে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন।
#### **শ্রেণীসংগ্রাম ও অভিনয়ে ব্যস্ততা**
ববিতা অভিনীত প্রতিটি চরিত্রই ছিল বৈচিত্র্যময়। তিনি যেমন শহুরে আদুরে মেয়ের চরিত্রে সাবলীল ছিলেন, তেমনই ছিলেন গ্রামের সরলমতি তরুণীর ভূমিকায়ও। তার অভিনয়ে একটি অসাধারণ সাদৃশ্য ছিল, যা তার চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলত।
ববিতা তার ক্যারিয়ারে অনেক স্মরণীয় সিনেমায় অভিনয় করেছেন। **‘নয়নমণি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘লাঠিয়াল’** প্রভৃতি সিনেমাগুলোতে তার অসাধারণ অভিনয় প্রতিভা দর্শকদের মন কেড়েছে। বিশেষ করে, **নারায়ণ ঘোষ মিতা** পরিচালিত **‘লাঠিয়াল’** ছবিতে তার অভিনয় সকলের হৃদয় স্পর্শ করেছিল।
#### **ব্যক্তিগত জীবন ও সম্পর্ক**
ববিতার ব্যক্তিগত জীবনও আলোচনার বিষয় হয়েছে বহুবার। বিশেষ করে, তার ও অভিনেতা **জাফর ইকবাল** এর সম্পর্ক নিয়ে দর্শকদের কৌতূহল ছিল তুঙ্গে। সিনেমার পর্দায় তাদের জুটি এবং বাস্তব জীবনে তাদের সম্পর্কের গুঞ্জন সেসময় সাধারণ মানুষের মধ্যেও আলোচিত হয়েছিল।
‘হারজিৎ’ এবং ‘এক মুঠো ভাত’ ছবিতে তাদের একসঙ্গে দেখা যাওয়ায় এই গুঞ্জন আরও বৃদ্ধি পায়।
**জাফর ইকবালের** বিয়ের খবরের পর অনেকেই হতাশ হয়েছিলেন, কিন্তু তখনো ববিতার জনপ্রিয়তা ও তারকা খ্যাতি অটুট ছিল।
#### **সত্যজিৎ রায়ের অনঙ্গ বৌ: ববিতা**
ববিতার ক্যারিয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হল সত্যজিৎ রায়ের **‘অশনি সংকেত’**। এই ছবিতে অভিনয় করেই তিনি আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বীকৃতি লাভ করেন। সত্যজিৎ রায়ের মতো গুণী পরিচালকের সঙ্গে কাজ করে ববিতা যে নিজের অভিনয় প্রতিভাকে আরও প্রসারিত করেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এই ছবির মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি শুধুমাত্র দেশীয় চলচ্চিত্রেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তারকারূপে পরিচিত হতে পারেন।
#### **কথোপকথন ও অভিমানের কথা**
কিছু বছর আগে ববিতার জন্মদিনে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। তার জন্মদিনে পত্রিকায় খবর ছাপা না হওয়ায় তিনি বেশ রাগান্বিত হয়েছিলেন। সহকর্মী একজনের মাধ্যমে ফোনে কথা বলার সময় তার অভিমানের কথা প্রকাশ পায়। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, তিনি নিজের কাজের প্রতি কতটা নিবেদিতপ্রাণ।
পরে যখন তাকে **মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার** দেওয়া হয়েছিল আজীবন সম্মাননা হিসেবে, তখন তিনি তার গুলশানের বাড়িতে আমাদের সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেদিন তিনি তার অভিনয় জীবন, শিল্পী ও পরিচালকদের সম্পর্ক, এবং চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন।
একবার এক সাংবাদিক তার জীবনী লিখতে চেয়েছিলেন। সেই সাংবাদিকের সাথে এক মজার গল্পের উল্লেখ করেছিলেন ববিতা। সাংবাদিক যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তার সম্পর্কে, তখন ববিতা জানতে চেয়েছিলেন, তিনি আদৌ কিছু জানেন কি না। সাংবাদিকের অদ্ভুত উত্তর শুনে ববিতা হতাশ হয়ে বলেছিলেন, ‘দয়া করে আমার জীবনী লিখতে যাবেন না।’
এ কথা উল্লেখ করার কারণ, একজন শিল্পীকে যথাযথ সম্মান করতে হলে তার সম্পর্কে আগে থেকে জানার গুরুত্ব অপরিসীম। ববিতা ছিলেন সেই সকল শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম, যারা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মান উন্নয়নে নিজেদের নিবেদিত করেছেন।
#### **শেষ কথা: ববিতার অবদান**
ববিতা তার জীবনের প্রতিটি ধাপে নিজেকে নতুনভাবে প্রমাণ করেছেন। চলচ্চিত্রে তার অবদান, অভিনয় দক্ষতা, এবং নানাবিধ চরিত্রে তার অভিনয় প্রতিভা সকলের কাছে অনুকরণীয়। তার হাসি, তার অভিনয়, তার ক্যারিয়ার সবই আজও আমাদের মুগ্ধ করে। চিরসবুজ এই অভিনেত্রীকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা এবং তার দীর্ঘায়ু কামনা করি।
### সম্পূর্ণরূপে একজন শিল্পীর প্রতিচ্ছবি
ববিতা একজন চিরসবুজ তারকা, যিনি শুধুমাত্র পর্দার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং চলচ্চিত্রের প্রতি তার নিবেদন এবং একাগ্রতা আজও আমাদের কাছে প্রেরণার উৎস। তার অভিনয় শিল্পী হিসেবে যাত্রা, তার ব্যক্তিগত জীবনের নানা অধ্যায় এবং চলচ্চিত্রের জগতে তার অনবদ্য অবদান আমাদেরকে প্রমাণ করে যে, তিনি শুধু একটি নাম নন, বরং এক জীবন্ত কিংবদন্তি।
তার জন্মদিনে তাকে স্মরণ করে আমরা শুধু তার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি না, বরং তার অনুপ্রেরণায় আগামীর দিনগুলোতেও আরও অনেক প্রতিভার উন্মোচনের আশা রাখছি। ববিতা, আমাদের সবার প্রিয় নক্ষত্র, যিনি আমাদের মনের আকাশে চিরজ্বলন্ত।
No comments: