Banner

**অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শ্বেতপত্র প্রণয়নের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার**

 বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য একটি শ্বেতপত্র (White Paper) প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই শ্বেতপত্রটি প্রণয়নের লক্ষ্য হলো বিগত ১৫ বছরে দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরে লুটপাট, অর্থ পাচার এবং দুর্নীতি নিয়ে একটি সমন্বিত ও বিশদ বিশ্লেষণ প্রকাশ করা। এই উদ্দেশ্যে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার পরিকল্পনা করেছে সরকার, যা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।

ছবিঃ সংগৃহীত

**শ্বেতপত্র প্রণয়নের উদ্যোগ:**


২০২৪ সালের ২১ আগস্ট, সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তার কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ‘বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ণ’ শীর্ষক একটি নোট উপস্থাপন করেন। এই নোটে বিগত ১৫ বছরের অর্থনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ এবং বর্তমান সরকারের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরা হয়েছে। 


নোটে উল্লেখ করা হয়েছে, গত দেড় দশকে দেশের অর্থনীতি চরম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। বিগত সরকারের সময় অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অবৈধ অর্থ পাচার এবং অপরিণামদর্শী প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি ঋণ গ্রহণের কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ে। 


**অর্থনৈতিক সমস্যার মূল কারণ:**


নোটে আরও বলা হয়েছে, বিগত শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সময় বাংলাদেশ প্রায় ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার ঋণের বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই ঋণের পরিমাণ দেশের তিনটি বাজেটের মোট অর্থ বরাদ্দের সমান। এছাড়াও, সরকার বাজেট ঘাটতি পূরণ করতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির পরিবর্তে দেশি ও বিদেশি ঋণের প্রতি নির্ভর করেছিল। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপির তুলনায় কর সংগ্রহের হার ১৪ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল, কিন্তু বাস্তবে এই হার ১১ শতাংশ থেকে নেমে ৮ শতাংশে পৌঁছেছে, যা অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার একটি প্রতিফলন।


**সামগ্রিক চ্যালেঞ্জ ও বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপট:**


নোটে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, এবং অর্থ পাচারের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, গত জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি প্রায় ১২ শতাংশে পৌঁছেছিল, এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। এসব চ্যালেঞ্জের মুখে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেশের নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে।


বর্তমান সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অর্থনীতি পুনরায় সচল করা, দীর্ঘদিন ধরে চলমান সমস্যাগুলোর কাঠামোগত সংস্কার করা, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, দুর্নীতি দূরীকরণ, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, কর ও শুল্ক নীতির সংস্কার, এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা।


**শ্বেতপত্রের প্রস্তাবিত বিষয়াদি:**


শ্বেতপত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো আলোকপাত করা হবে:

1. **Public Finance Management**: অভ্যন্তরীণ সম্পদ, সরকারি ব্যয় (সরকারি বিনিয়োগ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, ভর্তুকি ও ঋণ), এবং বাজেট ঘাটতি পূরণের অর্থায়ন।

2. **Inflation and Food Management**: উৎপাদন, সরকারি ক্রয় এবং সরকারি খাদ্য বিতরণ।

3. **External Balance**: রপ্তানি-আমদানি, রেমিট্যান্স, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (FDI), বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বৈদেশিক অর্থ প্রবাহ এবং ঋণ।

4. **Energy and Power**: চাহিদা, সরবরাহ, মূল্য নির্ধারণ, খরচ, এবং ক্রয় চুক্তি।

5. **Private Investment**: ঋণের প্রবেশাধিকার, বিদ্যুৎ সরবরাহ, সংযোগ এবং লজিস্টিকস।

6. **Employment**: দেশীয় এবং বিদেশে কর্মসংস্থান, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মজুরি, এবং যুব কর্মসংস্থান।


**কমিটি গঠন ও দায়িত্ব**:


এই শ্বেতপত্র প্রস্তুত করার জন্য দেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কমিটির সদস্যগণ অবৈতনিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন এবং পরিকল্পনা কমিশন কমপ্লেক্সে তাদের দপ্তর থাকবে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবে। সরকারী মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর এবং সংস্থাগুলো প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সরবরাহসহ সমস্ত ধরনের সহযোগিতা করবে। প্রস্তাবিত কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেবে।


শেষে, নোটে বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার সদয় বিবেচনা এবং অনুমোদনের জন্য এই প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে, যা সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

No comments:

Banner

Powered by Blogger.