Banner

পড়াশোনায় ফেরার আহ্বান ও নতুন বাংলাদেশের প্রতিজ্ঞা: ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বার্তা

**পড়াশোনায় ফেরার আহ্বান: ড. মুহাম্মদ ইউনূস

ছবিঃ সংগৃহীত

ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস ও ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি উল্লেখ করেছেন, বিপ্লবের সময় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাই, এখন সময় এসেছে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার। তিনি বলেন, "স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়েছে। তোমাদের ক্লাস ও ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ, বিপ্লবের সুফল ঘরে তুলতে আমাদের একটি সুশিক্ষিত ও দক্ষ প্রজন্মের দরকার।"


এই আহ্বানটি ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার দেওয়া হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়।


ড. ইউনূস তাঁর বার্তায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত সাহসী তরুণ, শ্রমিক, দিনমজুর, সাংবাদিকসহ পেশাজীবীদের স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধা জানান। একই সঙ্গে আহতদের অভিবাদন জানিয়ে তিনি বলেন, "আমাদের তরুণ বিপ্লবীরা দেশের মানুষের মনে নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন জাগিয়ে দিয়েছে, তা পূরণে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। শহীদদের আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করতে চাই। এক নতুন যুগের সূচনা করতে চাই।"


তিনি আরও বলেন, "আমরা আজ বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম মাস উদ্‌যাপন করছি। ইতিহাসের অন্যতম গৌরবময় বিপ্লবের জন্য শত শত ছাত্র এবং সর্বস্তরের মানুষ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তারা ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছেন, যার নেতৃত্বে নৃশংস একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। শেখ হাসিনা একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র এবং একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি রেখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। আমাদের বাংলাদেশকে এর পূর্ণ গৌরবে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব আমাদের।"


### বিপ্লব ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা


ড. ইউনূস বলেন, "বিপ্লবের সময় তরুণরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। তারা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন ঘুমহীন রাত কাটিয়েছে এবং দিনের বেলায় নিষ্ঠুর শাসনকে প্রতিহত করার জন্য রাস্তায় নেমেছে। বিপ্লব শেষ হওয়ার পর তারা দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও তাঁদের উপাসনালয় পাহারা দিয়েছে এবং সারা দেশে ট্রাফিক পরিচালনা করেছে। তাদের পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাই এখন সময় পড়াশোনায় ফেরার।"


তিনি আরও জানান, এক মাস হলো অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। প্রথম কাজ হলো জুলাই ও আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তারা এ দেশে এসে কাজ শুরু করে দিয়েছে। 


এ ছাড়া, জুলাই ও আগস্ট মাসে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইব্যুনাল তৈরির লক্ষ্যে শীর্ষ আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, "আমরা খুনিদের প্রত্যর্পণ এবং স্বৈরাচারের সময় দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ ও আমলারা যে পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তা দেশে ফিরিয়ে আনতে চাই। এ জন্য বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ শুরু করেছি।"


### আহতদের চিকিৎসা ও সাহায্য


প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তাঁদের প্রধান দায়িত্বগুলোর মধ্যে একটি হলো বিপ্লবের সময় গুরুতর আঘাত পাওয়া হাজার হাজার মানুষের বিনা মূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করা। "হাসিনার দুর্বৃত্তরা তাদের চোখ লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছোড়ায় অসংখ্য তরুণ শিক্ষার্থী দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করবে তাঁদের চোখের আলো ফিরিয়ে দিতে। শহীদ ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির জন্য ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা।"


শহীদদের পরিবারের জন্য একটি ফাউন্ডেশন তৈরির কাজও শেষ পর্যায়ে আছে, যা আহতদের চিকিৎসা ও শহীদদের পরিবারের দেখাশোনা করবে। তিনি আরও বলেন, "যাঁদের শাহাদাতের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, আমরা তাঁদের কখনোই ভুলব না।"


### গুমের ঘটনা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা


ড. ইউনূস বলপূর্বক গুম হওয়া থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করার কথা উল্লেখ করেন। এর ফলে স্বৈরাচার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘গুম সংস্কৃতির’ সমাপ্তি ঘটানোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন। আলাদাভাবে ফ্যাসিবাদী শাসনের ১৫ বছরে গুমের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করার জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। যেসব পরিবার তাদের নিখোঁজ পিতা, স্বামী, পুত্র এবং ভাইদের পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর ধরে যন্ত্রণার সঙ্গে অপেক্ষা করছে, তাদের বেদনায় তারা (সরকার) সমব্যথী।


প্রধান উপদেষ্টা আরও জানান, তাঁরা রাজনৈতিক দল, সম্পাদক, ব্যবসায়ী নেতা, সুশীল সমাজের নেতা এবং কূটনীতিকদের সঙ্গে ক্রমাগতভাবে বৈঠক করে যাচ্ছেন। তিনি তাঁদের সমর্থনের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, "আমরা কখনোই শহীদদের স্বপ্নের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।"


### জাতির প্রতি প্রতিজ্ঞা


ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, "আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এখন আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুঃশাসন ও স্বৈরাচার দ্বারা সৃষ্ট ক্ষত পূরণ করা। এ জন্য আমাদের প্রয়োজন একতা ও সমন্বয়। আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা নিলাম শহীদদের রক্ত এবং আহত ভাইবোনদের আত্মত্যাগকে জাতি হিসেবে আমরা কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেব না। যে সুযোগ তাঁরা আমাদের জন্য তৈরি করে দিয়েছেন, সে সুযোগকে আমরা কখনো হাতছাড়া হতে দেব না। আজ তাঁদের স্মৃতিময় দিনে আবারও প্রতিজ্ঞা করলাম, তাঁদের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ আমরা গড়বই।"

No comments:

Banner

Powered by Blogger.